Thursday, December 23, 2021

কার্তিক ভোরে

কার্তিকের ভোরবেলা কবে 
চোখে মুখে চুলের ওপরে 
যে শিশির ঝরল তা 
শালিক ঝরাল ব'লে ঝরে 

আমলকি গাছ ছুঁয়ে তিনটি শালিক 
কার্তিকের রোদে আর জলে 
আমারি হৃদয় দিয়ে চেনা তিন নারীর মতন; 

সূর্য? না কি সূর্যের চপ্পলে 
পা গলিয়ে পৃথিবীতে এসে 
পৃথিবীর থেকে উড়ে যায় 

এ জীবনে আমি ঢের শালিক দেখেছি 
তবু সেই তিনজন শালিক কোথায়?

Monday, February 23, 2015

স্বপ্ন

পান্ডুলিপি কাছে রেখে ধূসর দীপের কাছে আমি
নিস্তব্ধ ছিলাম ব'সে;
শিশির পড়িতেছিলো ধীরে-ধীরে খ'সে;
নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি

উড়ে গেলো কুয়াশায়, — কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো।
তাহারি পাখার হাওয়া প্রদীপ নিভায়ে গেলো বুঝি?
অন্ধকার হাৎড়ায়ে ধীরে-ধীরে দেশলাই খুঁজি;
যখন জ্বালিব আলো কার মুখ দেখা যাবে বলিতে কি পারো?

কার মুখ? —আমলকী শাখার পিছনে
শিঙের মত বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো তাহা;
এ-ধূসর পান্ডুলিপি একদিন দেখেছিলো, আহা,
সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।

তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,
পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ র'বে না আর, র'বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ
সেই মুখ আর আমি র'বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।

(মহাপৃথিবী, ১৯৪৪)


Wednesday, October 31, 2007

সূর্যতামসী


কোথাও পাখির শব্দ শুনি;
কোনো দিকে সমুদ্রের সুর;
কোথাও ভোরের বেলা র'য়ে গেছে - তবে।
অগণন মানুষের মৃত্যু হ'লে - অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়
বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে;
এ কোন সিন্ধুর সুর:
মরণের - জীবনের?
এ কি ভোর?
অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয় তবু।
একটি রাত্রির ব্যথা সয়ে -
সময় কি অবশেষে এ-রকম ভোরবেলা হয়ে
আগামী রাতের কালপুরুষের শস্য বুকে ক'রে জেগে ওঠে?
কোথাও ডানার শব্দ শুনি;
কোন দিকে সমুদ্রের সুর -
দক্ষিণের দিকে,
উত্তরের দিকে,
পশ্চিমের পানে?

সৃজনের ভয়াবহ মানে;
তবু জীবনের বসন্তের মতন কল্যাণে
সূর্যালোকিত সব সিন্ধু-পাখিদের শব্দ শুনি;
ভোরের বদলে তবু সেইখানে রাত্রি করোজ্জ্বল
ভিয়েনা, টোকিও, রোম, মিউনিখ - তুমি?
সার্থবাহ, সার্থবাহ, ওইদিকে নীল
সমুদ্রের পরিবর্তে আটলাণ্টিক চার্টার নিখিল মরুভূমি!
বিলীন হয় না মায়ামৃগ - নিত্য দিকদর্শিন;
যা জেনেছে - যা শেখেনি -
সেই মহাশ্মশানের গর্ভাঙ্কে ধূপের মত জ্ব'লে
জাগে না কি হে জীবন - হে সাগর -
শকুন্ত-ক্রান্তির কলরোলে।

(সাতটি তারার তিমির, ১৯৪৮)

Sunday, January 7, 2007

লোকেন বোসের জর্নাল

সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি — 
এখনো কি ভালোবাসি? 
সেটা অবসরে ভাববার কথা, 
অবসর তবু নেই; 
তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে 
এখন শেলফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভলভ ভাবে 
সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না। 

পুরোনো চিঠির ফাইল কিছু আছে: 
            সুজাতা লিখেছে আমার কাছে, 
বারো তেরো কুড়ি বছর আগের সে-সব কথা; 
            ফাইল নাড়া কি যে মিহি কেরানীর কাজ; 
            নাড়বো না আমি 
            নেড়ে কার কি লাভ; 
মনে হয় অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব, 
            সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে 
মানে এই — অমিতা বলছি যাকে — 
        কিন্তু কথাটা থাক; 
        কিন্তু তবুও — 
আজকে হৃদয় পথিক নয়তো আর, 
নারী যদি মৃগতৃষ্ণার মতো — তবে 
এখন কি করে মন কারভান হবে। 

প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি 
সেই সব মৃগতৃষ্ণিকাতলে ঈষৎ সিমুমে 
হয়তো কখনো বৈতাল মরুভুমি, 
হৃদয়, হৃদয় তুমি! 
তারপর তুমি নিজের ভিতরে ফিরে এসে তব চুপে 
মরীচিকা জয় করেছো বিনয়ী যে ভীষন নামরূপে 
সেখানে বালির সৎ নিরবতা ধূ ধূ 
প্রেম নয় তবু প্রমেরই মতন শুধু। 
অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে? 
অমিতা নিজে কি তাকে? 
            অবসর মতো কথা ভাবা যাবে, 
            ঢের অবসর চাই; 
            দূর ব্রহ্মাণ্ডকে তিলে টেনে এনে সমাহিত হওয়া চাই 
            এখনি টেনিসে যেতে হবে তবু, 
            ফিরে এসে রাতে ক্লাবে; 
কখন সময় হবে। 

হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোঁটে — 
            হৃদয় কেন যে কাঁপে, 
'ভালোবাসতাম' — স্মৃতি — অঙ্গার — পাপে 
            তর্কিত কেন রয়েছে বর্তমান। 
সে-ও কি আমায় — সুজাতা আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলো?
            আজো ভালোবাসে নাকি? 
ইলেকট্রনেরা নিজ দোষগুনে বলয়িত হয়ে রবে; 
কোনো অন্তিম ক্ষালিত আকাশে এর উত্তর হবে? 

সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে; 
            অমিতা কি মিহিজামে? 
বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে — সবই।
ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে; 
সময়ের এই স্থির এক দিক, 
            তবু স্থিরতর নয়; 
প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়।

Saturday, January 6, 2007

শীতরাত

এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে; 
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা, 
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো। 

শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে — 
সার্কাসের ব্যথিত সিংহের। 

এদিকে কোকিল ডাকছে - পউষের মধ্য রাতে;
কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব'লে?
কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার? 
তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ'য়ে যেতে দেখেছি, 
                                    তারা কিশোর নয়, 
কিশোরী নয় আর; 
কোকিলের গান ব্যবহৃত হ'য়ে গেছে। 

সিংহ হুঙ্কার ক'রে উঠছে: 
সার্কাসের ব্যথিত সিংহ, 
স্থবির সিংহ এক — আফিমের সিংহ — অন্ধ — অন্ধকার।
চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে
মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে
                                       যায় সব। 

সিংহ অরন্যকে পাবে না আর
পাবে না আর
পাবে না আর
কোকিলের গান
বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খ'শে খ'শে
চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।
হে পৃথিবী,
হে বিপাশামদির নাগপাশ,— তুমি
পাশ ফিরে শোও, 
কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর। 

(মহাপৃথিবী, ১৯৪৪)

Tuesday, April 18, 2006

মৃত্যু স্বপ্ন সংকল্প

আমাদের জানা ছিলো কিছু;
কিছু ধ্যান ছিলো;
আমাদের উৎস-চোখে স্বপ্নছটা প্রতিভার মতো
হয়তো-বা এসে পড়েছিলো;
আমাদের আশা সাধ প্রেম ছিলো; - নক্ষত্রপথের
অন্তঃশূণ্যে অন্ধ হিম আছে জেনে নিয়ে
তবুও তো ব্রহ্মাণ্ডের অপরূপ অগ্নিশিল্প জাগে;
আমাদেরো গেছিলো জাগিয়ে
পৃথিবীতে;
আমরা জেগেছি - তবু জাগাতে পারিনি;
আলো ছিলো - প্রদীপের বেষ্টনী নেই;
কাজ ছিলো - শুরু হলো না তো;
তাহলে দিনের সিঁড়ি কি প্রয়োজনের?
নিঃস্বত্ব সূর্যকে নিয়ে কার তবে লাভ!
স্বচ্ছল শাণিত নদী, তীরে তার সারস-দম্পতি
ঐ জল ক্লান্তিহীন উৎসানল অনুভব ক'রে ভালোবাসে;
তাদের চোখের রং অনন্ত আকৃতি পায় নীলাভ আকাশে;
দিনের সূর্যের বর্ণে রাতের নক্ষত্র মিশে যায়;
তবু তারা প্রণয়কে সময়কে চিনেছে কি আজো?
প্রকৃতির সৌন্দর্যকে কে এসে চেনায়!

- অংশবিশেষ -
(বেলা অবেলা কালবেলা, ১৯৬১)

Monday, April 17, 2006

আমাকে একটি কথা দাও

আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো
সহজ মহৎ বিশাল,
গভীর; - সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে
মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন,
আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর।
সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো:
সেই দিনের - আলোর অন্তহীন এঞ্জিন চঞ্চল ডানার মতন
সেই উজ্জ্বল পাখিনীর - পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে
অগ্নির মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন।

(বেলা অবেলা কালবেলা, ১৯৬১)

সপ্তক

এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে; - জানি না সে এইখানে
শুয়ে আছে কিনা।
অনেক হয়েছে শোয়া; - তারপর একদিন চ'লে গেছে
কোন দূর মেঘে।
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে :
সরোজিনী চলে গেলো অতদূর? সিঁড়ি ছাড়া - পাখিদের
মত পাখা বিনা?
হয়তো বা মৃত্তিকার জ্যামিতিক ঢেউ আজ? জ্যামিতির
ভূত বলে: আমি তো জানি না।
জাফরান - আলোকের বিশুষ্কতা সন্ধ্যার আকাশে আছে লেগে:
লুপ্ত বেড়ালের মত; শূণ্য চাতুরির মূঢ় হাসি নিয়ে জেগে।

(সাতটি তারার তিমির, ১৯৪৮)

Saturday, April 15, 2006

নির্জন স্বাক্ষর

তুমি তো জানো না কিছু - না জানিলে,
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে;
যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে -
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের 'পরে শুয়ে রবে?
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার!
তোমার এ জীবনের ধার
ক্ষ'য়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের 'পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই;
শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে?
আমি ঝ'রে যাবো - তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধ'রে সেদিন পৃথিবীর 'পরে,
- আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।

-- অংশবিশেষ --
(ধুসর পাণ্ডুলিপি, ১৯৩৬) 

Wednesday, April 12, 2006

অদ্ভুত আঁধার এক

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়
মহত্‍‌ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

যাত্রী

মনে হয় প্রাণ এক দূর স্বচ্ছ সাগরের কূলে
জন্ম নিয়েছিলো কবে;
পিছে মৃত্যুহীন জন্মহীন চিহ্নহীন
কুয়াশার যে ইঙ্গিত ছিলো --
সেই সব ধীরে ধীরে ভুলে গিয়ে অন্য এক মানে
পেয়েছিলো এখানে ভূমিষ্ঠ হয়ে -- আলো জল আকাশের টানে;
কেন যেন কাকে ভালোবেসে!

(অংশবিশেষ)

অন্য প্রেমিককে

মাছরাঙা চ'লে গেছে -- আজ নয় কবেকার কথা;
তারপর বারবার ফিরে এসে দৃশ্যে উজ্জল।
দিতে চেয়ে মানুষের অবহেলা উপেক্ষায় হ'য়ে গেছে ক্ষয়;
বেদনা পেয়েছে তবু মানুষের নিজেরও হৃদয়
প্রকৃতির অনির্বচনীয় সব চিহ্ন থেকে দু' চোখ ফিরিয়ে;
বুদ্ধি আর লালসার সাধনাকে সব চেয়ে বড় ভেবে নিয়ে।

মাছরাঙা চ'লে গেছে -- আজ নয় কবেকার কথা;
তারপর বারবার ফিরে এসে ডানাপালকের উজ্জলতা
ক্ষয় ক'রে তারপর হয়ে গেছে ক্ষয়।
মাছরাঙা মানুষের মতো সূর্য নয়?
কাজ করে কথা ব'লে চিন্তা করে চলেছে মানব;
যদিও সে শ্রেষ্ঠ চিন্তা সারাদিন চিন্তানাশা সাগরের জলে
ডুবে গিয়ে নিঃশব্দতা ছাড়া আর অন্য কিছু বলে?

(আলোপৃথিবী/১৩৮৮ বাংলা)

রবীন্দ্রনাথ

অনেক সময় পাড়ি দিয়ে আমি অবশেষে কোন এক বলয়িত পথে
মানুষের হৃদয়ের প্রীতির মতন এক বিভা
দেখেছি রাত্রির রঙে বিভাসিত হয়ে থেকে আপনার প্রাণের প্রতিভা
বিচ্ছুরিত ক'রে দেয় সঙ্গীতের মত কণ্ঠস্বরে!
হৃদয়ে নিমীল হয়ে অনুধ্যান করে
ময়দানবের দ্বীপ ভেঙে ফেলে স্বভাবসূর্যের গরিমাকে।
চিন্তার তরঙ্গ তুলে যখন তাহাকে
ডেকে যায় আমাদের রাত্রির উপরে -
পঙ্কিল ইঙ্গিত এক ভেসে ওঠে নেপথ্যের অন্ধকারে: আরো ভুত
আধেক মানব
আধেক শরীর - তবু অধিক গভীরতর ভাবে এক শব।

(অংশবিশেষ)
আলোপৃথিবী/১৩৮৮ বাংলা

Wednesday, March 29, 2006

একটি নক্ষত্র আসে

একটি নক্ষত্র আসে; তারপর একা পায়ে চ'লে
ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে
সে আসবে মনে হয়; - আমার দুয়ার অন্ধকারে
কখন খুলেছে তার সপ্রতিভ হাতে!
হঠাৎ কখন সন্ধ্যা মেয়েটির হাতের আঘাতে
সকল সমুদ্র সূর্য সত্বর তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাত্রি হতে পারে
সে এসে এগিয়ে দেয়;
শিয়রে আকাশ দূর দিকে
উজ্জ্বল ও নিরুজ্জ্বল নক্ষত্র গ্রহের আলোড়নে
অঘ্রানের রাত্রি হয়;
এ-রকম হিরন্ময় রাত্রি ইতিহাস ছাড়া আর কিছু রেখেছে কি মনে।

শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ, কলকাতা এখন
জীবনের জগতের প্রকৃতির অন্তিম নিশীথ;
চারিদিকে ঘর বাড়ি পোড়ো-সাঁকো সমাধির ভিড়;
সে অনেক ক্লান্তি ক্ষয় অবিনশ্বর পথে ফিরে
যেন ঢের মহাসাগরের থেকে এসেছে নারীর
পুরোনো হৃদয় নব নিবিড় শরীরে।

Thursday, March 23, 2006

হায় চিল

হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;

আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
                                        বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!

হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে 
তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!

(বনলতা সেন, ১৯৪২)

Wednesday, March 22, 2006

স্বভাব

যদিও আমার চোখে ঢের নদী ছিলো একদিন
পুনরায় আমাদের দেশে ভোর হ'লে,
তবুও একটি নদী দেখা যেতো শুধু তারপর;
কেবল একটি নারী কুয়াশা ফুরোলে
নদীর রেখার পার লক্ষ্য ক'রে চলে;
সূর্যের সমস্ত গোল সোনার ভিতরে
মানুষের শরীরের স্থিরতর মর্যাদার মতো
তার সেই মূর্তি এসে পড়ে।
সূর্যের সম্পূর্ণ বড় বিভোর পরিধি
যেন তার নিজের জিনিস।
এতদিন পরে সেইসব ফিরে পেতে
সময়ের কাছে যদি করি সুপারিশ
তা'হলে সে স্মৃতি দেবে সহিষ্ণু আলোয়
দু-একটি হেমন্তের রাত্রির প্রথম প্রহরে;
যদিও লক্ষ লোক পৃথিবীতে আজ
আচ্ছন্ন মাছির মত মরে -
তবুও একটি নারী 'ভোরের নদীর
জলের ভিতরে জল চিরদিন সূর্যের আলোয় গড়াবে'
এ রকম দু-চারটে ভয়াবহ স্বাভাবিক কথা
ভেবে শেষ হ'য়ে গেছে একদিন সাধারণভাবে।

(সাতটি তারার তিমির, ১৯৪৮)

সে

আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;
বলেছিলো: 'এ নদীর জল
তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল:
সব ক্লান্তি রক্তের থেকে
স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;
এই নদী তুমি।'

'এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?'
মাছরাঙাদের বললাম;
গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।
আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;
জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে
কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।

সময়ের অবিরল শাদা আর কালো
বনানীর বুক থেকে এসে
মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে
ঢের আগে নারী এক - তবু চোখ ঝলসানো আলো
ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি
না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী।